রঙিন চাল নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ছোলায়মান আলী ফকির এবং তার গবেষকদল। বলা হচ্ছে পুষ্টিগুণে ভরপুর এই চাল। এরইমধ্যে রঙিন ওই চাল দিয়ে পাকোড়া, চপ, কেকসহ নানান খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে প্রদর্শনী করেছেন বাকৃবির এই অধ্যাপক।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাদলে আরও যুক্ত ছিলেন কো-পিআই অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন-২ এবং স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ও সাগরিকা খাতুন।
গবেষক ড. ছোলায়মান আলী ফকির জানান, রঙিন চালের ধানের রং সোনালি, লাল, কালো, বেগুনি বর্ণের হতে পারে। কিন্তু চালের রং লাল, বেগুনি, বাদামি বা কালো হয়। পুষ্টিগুণের কারণে রঙিন চাল (ওরিজা স্যাটিভা এল) স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ি এলাকায় এবং প্রগতিশীল কৃষকরা রঙিন চাল চাষাবাদ করছেন। সাধারণ সাদা চালের তুলনায় এই চাল অধিক প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং আঁশসমৃদ্ধ।
রঙিন চালের চাষাবাদের বিষয়ে তিনি জানান, রঙিন চালের চাষাবাদ পদ্ধতি সাধারণ বাদামি বা সাদা চালের মতোই। এটি সাধারণত আমন মৌসুমে চাষ করা হলেও বোরো মৌসুমেও চাষ করা যেতে পারে। প্রায় সব ধরনের মাটি যেমন বেলে-দোআঁশ এবং কাদা মাটি রঙিন চাল চাষের জন্য উপযোগী।
চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে অধ্যাপক ছোলায়মান আলী জানান, প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম সার যথাক্রমে ১২০, ৬০, ৮০ এবং ৫০ কেজি ব্যবহার করা হয়। এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং অন্য সব সার একত্রে জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করা হয়। অবশিষ্ট ইউরিয়া সমান দুই ভাগে চারা রোপণের ২৫ ও ৫০ দিন পর মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। অঙ্কুরিত বীজ, বীজতলায় বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিন পর মূল জমিতে (২৫ সেমি. x ১৫ সেমি.) দূরত্বে রোপণ করা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে চারা রোপণ এবং ১১৫-১২১ দিন পরে ফসল তোলা হয়। নিড়ানি, সেচ এবং অন্য সব প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করা হয় এসময়ের মধ্যে।
সাধারণত রঙিন চালের ধানের ফলন অন্য ধানের চেয়ে কিছুটা কম, যা প্রতি হেক্টরে প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ টন। কালো চালের উচ্চমূল্য (কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা) হওয়ায় কম ফলনেও পুষে যায়। তবে কম ফলনের কারণ, অধিক রাসায়নিক সারের অসহনশীলতা, স্পাইকলেট বন্ধ্যাত্ব এবং অন্যান্য কারণ শনাক্ত করা গেলে ফলন বাড়তে পারে বলে জানান বাকৃবির এই অধ্যাপক।
- আরও পড়ুন
- আর কমবে না গাভীর দুধ উৎপাদন, ওলান প্রদাহের ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন
- বিদায়ী বছরে কৃষি গবেষণায় বাকৃবির ১২ সাফল্য
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয়দের খাবারে প্রোটিন, ভিটামিন, আঁশ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির প্রায়ই ঘাটতি থাকে। অথচ পুষ্টি ও ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ রঙিন চাল। এই চালের ব্রাণে প্রোটিন এবং আঁশের পরিমাণ সাদা চালের চেয়ে বেশি। এ আঁশ ডায়াবেটিক ও স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে। ব্রাণে প্রোটিন, ফ্লাভোনয়েড, ফেনল ও ভিটামিন রয়েছে, যা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে খুবই উপকারী।
ব্রাণের লাল রং সাধারণত এন্থোসায়ানিনের উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। এন্থোসায়ানিনসহ অন্যান্য ফাইটোক্যামিকেলসের প্রচুর স্বাস্থ্য গুণাগুণ বিদ্যমান। গবেষণায় জানা গেছে, এন্থোসায়ানিন ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ প্রশমিত করে। কালো চালের ভাত, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, চিড়া, মুড়ি, মুড়কি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পিঠা (চিতই ভাপা, পুলি, তেল পিঠা ইত্যাদি) ও কেক প্রস্তুত করা যায়। কালো চাল/চালের গুড়া সাদা চাল/চালের গুড়া সংমিশ্রণে বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত করা সম্ভব বলে দাবি করেন এই অধ্যাপক।
রঙিন চালের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যাপক ছোলায়মান আলী বলেন, রঙিন চাল অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার সহ্য করতে পারে না। ধানের দুগ্ধ অবস্থায় পাখি এবং পোকার দ্বারা আকৃষ্ট হতে পারে। অতএব, ধানের দানা দুগ্ধ অবস্থায় ক্ষেতে নেটিং দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। বেশিরভাগ রঙিন চালের জাত বিদেশি। ফলশ্রুতিতে উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিকর জিনোটাইপ উদ্ভাবন করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
আসিফ ইকবাল/এসআর/জিকেএস