গত তিন দশকে শিক্ষা, দারিদ্র্য হ্রাস ও উৎপাদনশীলতায় বড় ধরনের অগ্রগতি সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ভঙ্গুর আস্থা এবং প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে ধীর অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচারের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
নতুন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এসব তথ্য জানিয়েছে।
‘সামাজিক ন্যায়বিচারের অবস্থা: একটি চলমান কাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি নভেম্বর মাসে দোহায় অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনের আগে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এটি ১৯৯৫ সালের কোপেনহেগেন সামাজিক উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনের ৩০ বছর পূর্তিও চিহ্নিত করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালের তুলনায় আজকের বিশ্ব বেশি সম্পদশালী ও শিক্ষিত হলেও এই সুবিধাগুলো সমানভাবে ভাগ হয়নি এবং বৈষম্য হ্রাসের অগ্রগতি থেমে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে। চরম দারিদ্র্যও কমেছে, ৩৯ শতাংশ থেকে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ শতাংশে। একই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পন্নের হার ১০ শতাংশ বেড়েছে এবং বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনগণ প্রথমবারের মতো সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এসেছে।
আরও পড়ুন
অভিবাসন: স্বপ্নের যাত্রা নাকি দুঃস্বপ্নের ফাঁদ?
তবে প্রতিবেদনে কিছু তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। একজন ব্যক্তির আয়ের ৭১ শতাংশ এখনো জন্মসূত্রে নির্ধারিত, যেমন—কোন দেশে জন্ম হয়েছে বা তার লিঙ্গ কী। গত দুই দশকে অনানুষ্ঠানিক শ্রম মাত্র ২ শতাংশ কমলেও এখনো ৫৮ শতাংশ শ্রমিক এই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছেন। ২০০৫ সালের পর থেকে নারী-পুরুষের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ব্যবধান মাত্র ৩ শতাংশ কমেছে, তবুও তা ২৪ শতাংশে স্থির হয়ে আছে। আর বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে বৈশ্বিক লিঙ্গভিত্তিক মজুরিবৈষম্য দূর হতে আরও এক শতাব্দী সময় লাগবে।
আইএলও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ১৯৮২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছে, যা দেখায় মানুষ ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশ হচ্ছে যে তাদের প্রচেষ্টা ন্যায্যভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে না।
আইএলও সতর্ক করেছে, সামাজিক চুক্তি শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ না নিলে আস্থার এই ক্ষয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বৈশ্বিক সহযোগিতার বৈধতাকে দুর্বল করতে পারে।
এতে বলা হয়, এই ফলাফলগুলো এমন সময়ে সামনে এসেছে যখন বিশ্ব গভীর পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশগত, ডিজিটাল এবং জনমিতিক পরিবর্তনগুলো অভূতপূর্ব গতিতে শ্রমবাজারকে রূপান্তর করছে। সচেতন নীতি গ্রহণ না করলে এই পরিবর্তনগুলো বৈষম্যকে আরও গভীর করতে পারে। তবে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে– যেমন দক্ষতায় বিনিয়োগ, সামাজিক সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি ব্যবস্থা এবং সক্রিয় শ্রমবাজার নীতি– এগুলো অন্তর্ভুক্তি ও সহনশীলতার ইঞ্জিনে পরিণত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আইএলও মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ. হাউংবো বলেন, ‘বিশ্ব নিঃসন্দেহে অগ্রগতি লাভ করেছে, তবে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না যে লাখ লাখ মানুষ এখনো সুযোগ এবং মর্যাদাপূর্ণ কাজ থেকে বঞ্চিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার শুধু একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা নয়– এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক সম্প্রীতি এবং শান্তির জন্য অপরিহার্য।’
প্রতিবেদনে অসম সুযোগ দূরীকরণ, অর্থনৈতিক অর্জনের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশগত, ডিজিটাল ও জনমিতিক পরিবর্তনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যেন কেউ পিছিয়ে না থাকে।
এতে বলা হয়েছে, অর্থনীতি ও শিল্প থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও জলবায়ু– সব নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে সামাজিক ন্যায়বিচারকে রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যেন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
আইএলও জানায়, এই ফলাফলগুলো আসন্ন নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে গ্লোবাল কোয়ালিশন ফর সোশ্যাল জাস্টিস-এর কাজকে সহায়তা করবে।
আইএলও নেতৃত্বাধীন প্ল্যাটফর্মটি সরকার, নিয়োগদাতা, শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্য অংশীদারদের একত্রিত করে, যেন তারা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কাজ অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ ও সহযোগিতা জোরদার করতে পারে।
জেপিআই/ইএ/এমএস