সূর্যের আলো ভিটামিন ‘ডি’র প্রধান উৎস। তবে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভিটামিন ডি ঘাটতির প্রবণতা ব্যাপক। মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অনুপুষ্টির ঘাটতি মোকাবিলায় সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে এবং ভোজ্যতেলে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধকরণকে একটি সম্ভাব্য উপায় হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে শিশুরা রিকেটস রোগের শিকার হতে পারে এবং প্রাপ্তবয়স্করা অস্টিওপোরোসিস নামক দুর্বল হাড়ের রোগে ভুগতে পারেন। ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে মাতৃত্বজনিত জটিলতা যেমন- প্রি-এক্লাম্পসিয়া, নবজাতকের জটিলতা যেমন- নবজাতকের হাইপোক্যালসেমিয়াজনিত খিঁচুনি যেমন হতে পারে তেমনি দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ যেমন- হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বছরে যত মানুষ মারা যায় তার ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী অসংক্রামক রোগ। ভিটামিন ‘ডি’ অভাবজনিত সমস্যা এই পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১৯-২০ অনুযায়ী, প্রতি চারজনের মধ্যে একজন (২২%) ৫ বছরের কম বয়সী শিশু এবং তিনজনের মধ্যে দুজন (৭০%) গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নন এমন নারীর মধ্যে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি পাওয়া গেছে। অনেকেই মনে করেন শহরে বসবাসকারী মানুষ সূর্যালোকের সংস্পর্শে কম আসে বিধায় তাদের শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ -এর ঘাটতি বেশি। কিন্তু গবেষণায় শহরের পাশাপাশি গ্রামে বসবাসকারী মানুষের মধ্যেও ভিটামিন ‘ডি’-এর উচ্চ ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবজনিত ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও এই দিকটি নীতিনির্ধারকদের কাছে কেন এখনো উপেক্ষিত রয়ে গেল তা বোধগম্য নয়।
প্রধানত সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ‘ডি’ শরীরে তৈরি হলেও প্রাকৃতিক খাবার থেকেও এই ভিটামিনের চাহিদা আংশিক পূরণ করা যায়। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডিমের কুসুম, তৈলাক্ত মাছ, লাল মাংস, কলিজা, মাশরুম ইত্যাদি। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ এই সমস্ত খাবার কম খায়, ভাত এবং অন্যান্য শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খেয়ে থাকেন। তদুপরি জনসাধারণের মধ্যে ভিটামিন ‘ডি’-এর গুরুত্ব এবং এর ঘাটতি প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অধিকাংশ মানুষ এখনো জানেন না দিনের কোন সময়ে, কত সময় এবং কীভাবে সূর্যের আলোতে কাটাতে হবে। আবার বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি করার সুযোগ কমে গেছে। বিনামূল্যে এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে ভিটামিন ‘ডি’ পেতে হলে জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
ভিটামিন ‘ডি’ অভাবজনিত সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই রয়েছে এমন নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ভারত, পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যেমন ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতি প্রকট, তেমনি ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করে যে, ২০ শতাংশ বা এর বেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিটামিন ‘ডি’ এবং এ জাতীয় অনুপুষ্টিজনিত ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য।
ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতিজনিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় বেশ ব্যয়বহুল। ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতি প্রতিরোধে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তার মধ্যে রয়েছে- সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে প্রচারণা চালানো, ভিটামিন ‘ডি’ -সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং এসব খাবার সহজলভ্য করা, নারী ও বয়স্কদের জন্য বিনামূল্যে ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্ট সরবরাহ করা এবং ভিটামিন ‘ডি’র সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সবাই ব্যবহার করেন এমন কোনো খাবারে ভিটামিন ‘ডি’ যোগ করা, যাকে ফর্টিফিকেশন বলা হয়ে থাকে। আপামর জনসাধারণের মধ্যে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে খাদ্যপণ্যে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি কার্যকর পদ্ধতি এবং ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এটি চালু রয়েছে।
জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুপুষ্টির ঘাটতি পূরণে খাদ্যপণ্যে ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধকরণ বাংলাদেশে নতুন নয়। দেশে লবণে আয়োডিন এবং ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের ব্যবহার সর্বজনীন এবং ভিটামিন ‘ডি’ চর্বিতে দ্রবণীয়, সেহেতু ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণের জন্য একটি উপযুক্ত বাহন হতে পারে। তদুপরি, ভোজ্যতেল একইসাথে ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘ডি’ দ্বারা সমৃদ্ধকরণ শুধু ভিটামিন ‘এ’ দ্বারা সমৃদ্ধকরণের চেয়ে সাশ্রয়ী। এতে জনগণ প্রতিদিনের ভোজ্যতেলে একই সাথে ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘ডি’ পাবে।
ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতির উচ্চ প্রকোপকে গুরুত্ব দেওয়া এবং এর প্রতিরোধকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। ভিটামিন ‘ডি’ ঘাটতির উচ্চ প্রকোপ সার্বিকভাবে রোগের বোঝা বাড়াবে। তাই, সরকার, নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে এবিষয়ে কাজ করতে হবে। ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা সরকার এবং জনগণ উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে।
লেখকদ্বয় : অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী : বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
ডা. রীনা রাণী পাল : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি অ্যাডভোকেসি বাংলাদেশ, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট