ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি

2 weeks ago 12

ভ্রমণ মানেই শুধু নতুন জায়গা দেখা নয়, ভ্রমণ মানে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা। পৃথিবীর প্রতিটি ভ্রমণপথে লুকিয়ে থাকে গল্প কষ্টের, সাহসের, ভয় জয়ের আর শেষে শান্তি খোঁজার। কেনিয়ার গ্রেট রিফট ভ্যালি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার কাছে ঠিক তেমনই এক গল্প; যেখানে পাহাড়ি কঠিন রাস্তায় পাথরের খাঁজে খাঁজে দুলতে দুলতে ভয়ের অন্ধকার গিলে খেতে খেতে অবশেষে আলোয় পৌঁছানো।

আমার চোখে পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম এবং ভয়ংকর পথ ছিল এটি। রিফট ভ্যালির পাশে আমাদের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম এ কোনো সহজ সফর নয়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে একটিও মসৃণ ঢালাই ছিল না, পুরোপুরি পাথরের রাস্তাই আমাদের সঙ্গী। গাড়ি যেন বারবার হোঁচট খাচ্ছিল, টায়ার যে কোনো সময় পাংচার হতে পারে এই আশঙ্কা বুকের মধ্যে ভর করেছিল প্রবলভাবে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল হয়তো এখানেই গাড়ি আটকে যাবে, আমরা অচল হয়ে যাবো এই নিঃসঙ্গ দুর্গম পথে।

৬০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাদের লেগেছিল প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। পথ এতটাই কঠিন এতটাই ভীতিকর ছিল যে, মনে হচ্ছিল একেকটা মিনিট যেন একেকটা ঘণ্টার সমান দীর্ঘ। কিন্তু মানুষ জানে, যত কষ্টই হোক সৌন্দর্যের মুখোমুখি হওয়ার আগে সব কষ্ট একদিন তুচ্ছ মনে হয়। ঠিক তেমনই হলো আমাদের ক্ষেত্রেও।

ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি

রিফট ভ্যালির দৃশ্য যখন আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হলো; তখন মনে হলো পুরো পৃথিবী যেন আমাদের জন্য সাজানো এক শিল্পকর্ম। পাহাড়ের খাড়া ঢাল, ভ্যালির গভীরতা, আগ্নেয় শিলার স্তর আর দূরে দেখা যাওয়া নীলাভ হ্রদ সব মিলিয়ে মন ভরে উঠল এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে। মনে হলো এত কষ্ট, এত দুঃখ, এত ভয় সবকিছুরই আজ সার্থকতা মিললো।

রিফট ভ্যালি, প্রকৃতির এক বিস্ময়। আমাদের এই অভিজ্ঞতা শুধুই ভ্রমণের ছিল না, এটি ছিল ইতিহাস আর ভূবিজ্ঞানের সঙ্গেও এক সশরীর সাক্ষাৎ। কারণ গ্রেট রিফট ভ্যালি শুধু কেনিয়ার একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আসলে একটি অন্তঃমহাদেশীয় রিজ সিস্টেম, যা পূর্ব আফ্রিকাকে যেন দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে।

গ্রেগরি রিফট নামে পরিচিত এই অংশটি পূর্ব আফ্রিকান রিফটের পূর্ব শাখার অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণে তানজানিয়া থেকে শুরু হয়ে উত্তরে ইথিওপিয়া পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। ভূবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে আরবীয় নুবিয়ান এবং সোমালিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ আর বিচ্ছিন্নতার ফলে হাজার হাজার বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল এই রিফট। ভূ উত্তল কেনিয়ান ডোম নামক স্থানে যখন এই টেকটনিক পরিবর্তন ঘটল; তখন গড়ে উঠল আজকের এই রিফট ভ্যালি।

ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি

একসময় ধারণা করা হতো যে, এই রিফট ভ্যালি শুরু হয়েছে দূর মাদাগাস্কার থেকে আর শেষ হয়েছে সিরিয়া পর্যন্ত। যদিও পরবর্তী গবেষণা সেটি সংশোধন করেছে। তবুও বোঝাই যায় এর মহিমা কতটা ব্যাপক। বোঝা যায়, প্রকৃতির রূপ-রস ও বৈচিত্র্য।

রিফট ভ্যালির চারপাশে খাড়া পাহাড়ি প্রাচীর, যাকে বলা হয় এস্কার্পমেন্ট। এগুলো যেন প্রকৃতির আঁকিবুঁকি, যা ভ্যালিকে দুই দিক থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ভ্যালির তলদেশে ছড়িয়ে আছে একাধিক আগ্নেয়গিরি, যাদের কিছু এখনো সক্রিয়। এই আগ্নেয় মাটির কারণে এখানকার জমি অত্যন্ত উর্বর, যা স্থানীয় কৃষকদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

এখানকার আবহাওয়া বেশ মৃদু। সাধারণত তাপমাত্রা ২৮° সেলসিয়াসের বেশি হয় না। বর্ষা আসে বছরে দুবার, মার্চ থেকে জুন আর অক্টোবর থেকে নভেম্বর। কিন্তু ভ্যালির ভেতরে রয়েছে এক বিস্ময়কর বৈচিত্র্য; উত্তরে শুষ্ক মরুভূমি, দক্ষিণে সবুজ বন আর মাঝখানে অগণিত হ্রদ।

ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি

কেনিয়ার প্রায় ৯.৫ শতাংশ হ্রদই এই রিফট ভ্যালির ভেতরে। উত্তর থেকে দক্ষিণে একের পর এক সাজানো যেন প্রকৃতির মুক্তো মালা লেক তুরকানা, লেক লগিপি, লেক বারিঙ্গো, লেক বগোরিয়া, লেক নাকুরু, লেক এলিমেন্টাইটা, লেক নাইভাশা এবং লেক মাগাদি।

আরও পড়ুন

শুধু লেক বারিঙ্গো ও নাইভাশাই মিঠা পানির, বাকি সব হ্রদই ক্ষারীয়। এর ফলে তৈরি হয়েছে বিশেষ ধরনের জীববৈচিত্র্য। ক্ষারীয় জলে জন্মায় নীল সবুজ শৈবাল যা আবার লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের প্রধান খাদ্য। তাই দেখা যায়, এখানে বিশাল ঝাঁকে ফ্লেমিঙ্গো এসে হ্রদের পাড় রাঙিয়ে দেয় গোলাপি রঙে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, কেনিয়া লেক সিস্টেম লেক বগোরিয়া, লেক নাকুরু এবং লেক এলিমেন্টাইটা। তিনটি হ্রদ মিলে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর অন্যতম পাখির স্বর্গরাজ্য। এখানে ১৩টি বিশ্ববিপন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। গ্রেট হোয়াইট পেলিকানের প্রধান প্রজনন কেন্দ্রও এটি।

রিফট ভ্যালির ভেতরে একের পর এক আগ্নেয়গিরি যেন দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে। মাউন্ট লঙ্গোনট, মাউন্ট সুসওয়া, মেনেঙ্গাই সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির। মেনেঙ্গাইয়ের বিশাল ক্যালডেরা প্রায় ৮০০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এখনো তার প্রভাব দেখা যায়।

ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি

দক্ষিণে আছে লেক মাগাদি, যেখান থেকে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সোডিয়াম কার্বনেট উৎপাদন করা হচ্ছে। লেক বারিঙ্গোর আশেপাশে পাওয়া গেছে রুবি ও গোলাপি শীলা। প্রকৃতি যেন এখানে তার প্রতিটি রত্ন লুকিয়ে রেখেছে।

রিফট ভ্যালি শুধু ভূবিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি হলো জীববৈচিত্র্যের এক অমূল্য ভান্ডার। লেকসংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া যায় ব্ল্যাক রাইনো, রথশাইল্ড জিরাফ, গ্রেটার কুডু, সিংহ, চিতা এবং বন্য কুকুর। পাশাপাশি এটি ওয়েস্ট এশিয়ান ইস্ট আফ্রিকান ফ্লাইওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এসে আশ্রয় নেয়।

আমাদের সেই ভ্রমণকাহিনিতে ফিরে গেলে মনে পড়ে ভয় ছিল নিত্যসঙ্গী। গাড়ি পাথরের খাঁজে আটকে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল হয়তো আর এগোনো যাবে না। কিন্তু ঠিক সেই ভয় জয়ের মুহূর্তেই সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায় সবচেয়ে গভীরভাবে।

যখন পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আমরা রিফট ভ্যালির সামনে দাঁড়ালাম, মনে হলো প্রকৃতি আমাদের সব কষ্টের পুরস্কার দিয়েছে। এমন প্রশান্তি, এমন শান্তি আমি জীবনে খুব কমই অনুভব করেছি। সত্যিই রিফট ভ্যালি হলো আফ্রিকার বুকের ওপর আঁকা এক অলৌকিক ছবি।

তানজানিয়া থেকে কেনিয়া, রিফট ভ্যালির এক অখণ্ড স্রোত। রিফট ভ্যালি কেবল কেনিয়াতেই নয়, এর ধারা নেমে গেছে তানজানিয়ার ভেতরেও।

এসইউ/এমএস

Read Entire Article