মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা বিপথগামী কিছু প্রবাসী আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তারা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে দীর্ঘদিন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। সেখানে বসেই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করেন, ছড়িয়ে দিতে চান জঙ্গিবাদ। নিজেরাই অর্থায়ন করে গঠন করেন তহবিল, সদস্য সংগ্রহসহ কার্যক্রম বিস্তারে সহযোগিতা নেন কতিপয় বাংলাদেশির পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বসে জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে কয়েকজন প্রবাসীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে গত ১ আগস্ট প্রবাসী সজীব মিয়াকে (৩১) তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। সজীব মিয়া গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার রানীগঞ্জ গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান। তার জবানবন্দিতে মালয়েশিয়ায় বসে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্য থেকে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াটি তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সম্পন্ন করতেন।
আরও পড়ুন
- কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশিসহ ১৭১ অভিবাসী আটক
- শর্ত সাপেক্ষে উন্মুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার
- আটক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন
সজীব মিয়ার জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন সূত্রে জানা যায়, পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামি সজীব স্বীকার করেন, মামলার অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে উক্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করেন। মালয়েশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তিনি মালয়েশিয়ার আইপি ঠিকানা ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতায় বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্য থেকে কতিপয় সদস্য সংগ্রহ করেন। একই সঙ্গে আসামিরা সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা চালান। আসামি সজীব মিয়া সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য হয়ে আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের এবং অন্যদের স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুদানের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করতেন। তিনি সংগৃহীত অর্থ ই-ওয়ালেট এবং আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তর পরিষেবার মাধ্যমে অন্যান্য দেশে অর্থ প্রেরণ করতেন।
সজীব মিয়া সন্ত্রাসী সংগঠনটির সদস্য হিসেবে বছরে ৪৮০ রিংগিত (প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা) চাঁদা প্রদান করতেন। এছাড়াও আসামি নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো বার্তা বিনিময় অ্যাপস ব্যবহার করতেন।
এদিকে এ মামলায় সোমবার (৪ আগস্ট) মো. ওয়াসিম আকরাম নামে আরও এক আসামিকে তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তিনি নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার মৃত খয়ের উদ্দিন শেখের ছেলে। তাকে রোববার (৩ আগস্ট) রাজধানীর কাফরুলের বাইশটেকী এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
রিমান্ডের আবেদন সূত্রে জানা গেছে, মো. ওয়াসিম আকরাম ও সজীব মিয়া অন্য আসামিদের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় বসে অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করতেন। ওয়াসিম সন্ত্রাসী সংগঠনটির সদস্য হিসেবে বছরে ৫০০ রিংগিত (প্রায় ১৪ হাজার টাকা) চাঁদা প্রদান করতেন। তিনি নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো বার্তা বিনিময় অ্যাপস ব্যবহার করতেন মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ওয়াসিম দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে নতুন সদস্যদের সঙ্গে উগ্রবাদী কনটেন্ট আদান-প্রদান করতেন।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(৩)/৭(৩)/১০/১৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা সুমন জাগো নিউজকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে বিদেশে বসে দেশের মাটিতে জঙ্গিবাদ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে আজ আসামি সজীব মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মামলার রহস্য উদঘাটন সহজ হবে।
আরও পড়ুন
- নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভিযোগ: মেজর সাদিক সেনা হেফাজতে
- শরীয়তপুরে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ সন্দেহে তরুণ গ্রেফতার
এর আগে গত ৮ জুলাই মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমানবন্দর থানার মামলায় গ্রেফতার অপর চার প্রবাসীর চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন- নজরুল ইসলাম সোহাগ, মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, জাহেদ আহমেদ এবং মাহফুজ।
জানা গেছে, রিমান্ডে যাওয়া চারজনের মধ্যে নজরুল ইসলাম সোহাগ, মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, জাহেদ আহমেদকে গত ৪ জুলাই মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) তাদের হেফাজতে নেন। পরে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়েরের পর তাদের এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে ৭ জুলাই কুমিল্লা থেকে অপর আসামি মাহফুজকে গ্রেফতার করা হয়। তারা চারজনই এজাহারনামীয় আসামি।
গত ৫ জুলাই অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ইনটেলিজেন্স শাখার পুলিশ পরিদর্শক মো. আব্দুল বাতেন বাদী হয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় ৩৫ প্রবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তারা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তারা মালয়েশিয়ার আইপি ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশি কতিপয় নাগরিকের মাধ্যমে পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ এবং প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আসামিরা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে দেশটির জননিরাপত্তা ও জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কর্যক্রম পরিচালনা করেন। পরে গত ২৮ এপ্রিল থেকে ২১ জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ান পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। আসামিরা সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য হয়ে আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুদানের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেন। পরে সংগৃহীত অর্থ ই-ওয়ালেট এবং আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তর পরিষেবার মাধ্যমে অন্যান্য দেশে অর্থ প্রেরণ করে। সংগঠনটির সদস্য হিসেবে তারা বছরে ৫০০ রিংগিত চাঁদা প্রদান করতেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, গ্রেফতার ও পলাতক আসামিদের মালয়েশিয়ান পুলিশ পর্যায়ক্রমে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গোয়েন্দা তথ্য ও অপরাপর তথ্যের আলোকে জানা গেছে, আসামিরা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে এসে সন্ত্রাসবাদে জড়িত হয়ে উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জননিরাপত্তা, জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা এবং যে কোনো সময় বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এমআইএন/ইএ/এমএস