প্রধান সড়ক ধরে হেঁটে চলছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে-কখনো খাঁচাভর্তি পাখি হাতে, কখনো আবার খালি খাঁচা হাতে কিছু পথচারী হাঁটছেন। তারা কোথা থেকে আসছে বা কোথায় যাচ্ছে-বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছিল। কিছু সময় পর, এক পথচারীকে সামনে দিয়ে পাখিসহ খাঁচা নিয়ে যেতে দেখে তার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল, তার পথেই হয়তো পাখিদের কোনো রহস্যময় জগৎ অপেক্ষা করছে। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকি। একসময় কানে ভেসে আসে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। যতই এগিয়ে যাই, এই শব্দ যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। মনে হচ্ছিল, একটা অদৃশ্য সুরের স্রোত আমাকে টেনে নিচ্ছে তার ভেতরে।
এক পর্যায়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হয়। চোখের সামনে যা দেখলাম, তাতে সত্যি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু দেশি-বিদেশি নানা জাতের রঙিন পাখি, ডাকডাকি, নড়াচড়া, উড়াউড়ি-সব মিলিয়ে অন্য রকম জগৎ। একসঙ্গে এত পাখি আগে কখনো দেখি নাই।
চারদিকের গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল, হাটবাজারের শব্দের মাঝেও পাখিদের সেই সুরেলা ডাক ছিল এক অন্যরকম প্রশান্তির উৎস। মনে হচ্ছিল, ব্যস্ত শহরের কোলাহলের মাঝে একখণ্ড শান্তির দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন-আমি বলছি এক বিশেষ জায়গার কথা, পাখিপ্রেমীদের প্রিয় এক গন্তব্যের কথা। হ্যাঁ, এটি কোনো সাধারণ বাজার নয়, এটি রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মিরপুর ১ নম্বরে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় পাখির হাট। প্রতি শুক্রবার জমে ওঠে এই হাট। শাহ্ আলী স্কুলের সামনের সড়ক থেকে শুরু হয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথজুড়ে বিস্তৃত থাকে হাটের আয়োজন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে বেচা-কেনা, আর চারপাশে থাকে প্রাণের উচ্ছ্বাস।
দেশি-বিদেশি নানা জাতের, আকার ও রঙের কবুতর পাওয়া যায়
দূরদূরান্ত থেকে নানা জাতের রং-বেরঙের পাখি এসে হাজির হয় এই হাটে-কারো খাঁচায় কবুতর, টিয়া, ঘুঘু, কারো ঝুড়িতে বাজরিগার, আবার কারো পাঁজরে সানকনুর। বিক্রেতারা একে একে তাদের পসরা সাজিয়ে বসেন, আর ক্রেতারাও ভিড় করেন নিজেদের পছন্দের পাখি বেছে নিতে।
তবে শুধু পাখিই নয়-এই হাটে চোখে পড়ে বিভিন্ন জাতের মুরগি, বিড়াল, খরগোশের মতো পোষ্য প্রাণীও। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বিক্রেতারা নিয়ে আসেন নানা আয়োজন-নতুন নতুন জাতের পাখি, বাহারি খাঁচা, খাবারদানা, আর কখনো কখনো দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়ও। হাটের সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন একটি পাখি হচ্ছে বাজরিগার। এর দাম জোড়া শুরু হয় ৪০০ টাকা থেকে।
শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতেই সীমাবদ্ধ নয় এই পাখির হাট। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে, বাহারি রঙের ও নানা প্রজাতির পাখি দেখতে শিশু থেকে বৃদ্ধ-সব বয়সী মানুষ ছুটে আসেন। পাখির প্রতি ভালোবাসা, শখ, আর প্রাণীবন্ধুত্বের এক প্রাণবন্ত চিত্র ফুটে ওঠে মিরপুরের এই হাটে। যেখানে অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়, পাখি নিয়ে আলোচনা চলে। তাই অনেকের কাছেই এটি শুধু হাট নয় এক ধরনের শুক্রবারের বিনোদন কেন্দ্র।
পাখির হাটে বিক্রেতারা নানা ধরনের। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা-হাতে খাঁচা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ বুঝে ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেন, পাখি দেখান। আবার অধিকাংশ বিক্রেতাই স্থায়ীভাবে পরপর খাঁচা সাজিয়ে বসেন থাকেন। তবে তাদের কাজটা শুধুই পাখি বেচাকেনায় সীমাবদ্ধ নয়। বিক্রেতাদের বেশিরভাগ সময় কাটে পাখি সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণে-পাখির বয়স, লিঙ্গ, খাওয়া-দাওয়া, যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি ইত্যাদি ক্রেতাদের জানান। অনেক সময় তারা পাখি পালনের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন।
সাধারণ ছোট খাঁচা ২৫০ টাকা থেকে শুরু হয়
হাট ঘুরে যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, তা হলো-কবুতরের আধিক্য। দেশি-বিদেশি নানা জাতের কবুতরের ছাড়ছড়ি। বিভিন্ন আকার, রং ও বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব কবুতর অনেকের নজর কাড়ে। পাখির দাম নির্ধারিত হয় মূলত তার জাত, রং, চাহিদা এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। তবে সবচেয়ে বেশি দাম কথা বলা পাখির। এসব পাখির দাম হাজার থেকে শুরু করে কখনো কখনো লাখ টাকা পর্যন্ত হয়।
এই হাট শুধু পাখি কেনাবেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। খাঁচা, খাবার, রিং, লক, ওষুধসহ পাখি পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সব ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া যায়। সাধারণ ছোট খাঁচা ২৫০ টাকা থেকে শুরু হয়ে, উন্নত মানের বড় খাঁচা হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হয়। খাঁচার ধরন ও আকার অনুযায়ী দামও ভিন্ন হয়। প্রতিটি পাখির জন্য রয়েছে ভিন্ন ধরনের খাবার, আর সেই অনুযায়ী দামও নির্ধারিত। অনেক দোকানে বিশেষ ভিটামিন মিশ্রিত পাখির খাবারও পাওয়া যায়। খাবারের দাম শুরু হয় ৫০ টাকা থেকে।
দুইটি খাঁচায় ১০-১২টি কবুতর নিয়ে হাটের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানা গেল তার নাম ইসমাইল। সে মিরপুর-১ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ইসমাইল বলেন, ‘২০২১ সালের দিকে মামা আমাকে কয়েকটা কবুতর উপহার দেন। তখন থেকেই বাসার ছাদে কবুতর পালা শুরু করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবুতরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমার কাছে রয়েছে নানা জাতের কবুতর। কবুতর পালনের প্রতি মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের মতো টাকা লাগে। টিফিনের টাকা জমিয়ে রাখি, আর মাঝে মাঝে কবুতর বিক্রি করে যে টাকা পাই, তা দিয়েই খরচ মিটাই। এক জোড়া কবুতর বিক্রি করি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। সংখ্যায় যখন বেশি হয়, তখন কিছু বিক্রি করেই সামাল দেয় খরচ।’
বাবার সঙ্গে খাঁচায় পাখি হাতে আহানাফ
মো. আলামিন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) চাকরি করেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে এসেছেন পাখির হাটে। তিনি বলেন, ‘এক সময় নিজেও পাখি পালতাম। এখন সন্তানদের শখ পূরণে পাখি পালনে একজন বাবা হিসেবে সহায়তা করি। আমাদের বাসায় টিয়া, ঘুঘু, সানকনুরসহ বিভিন্ন জাতের পাখি রয়েছে। আজ ছুটির দিনে ওদের নিয়ে পাখির হাটে এসেছি। পাঁচটি নতুন পাখিও কিনেছি। একই সঙ্গে পাখিদের জন্য খাবার এবং ছোট ছোট প্লাস্টিকের বক্সও কিনেছি। বাবা হিসেবে সন্তানদের এসব ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে খুব ভালো লাগে। বাসায় অবসর সময়ে আমিও পাখিদের যত্ন নিই, তবে ওরা ভাইবোনই বেশি সময় দেয়।’
তার ছেলে আহানাফ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে বলে, ‘পাখি পালতে আমার খুব ভালো লাগে। পাখিদের সঙ্গে আমাদের দারুণ সময় কাটে। বড় হয়ে চাকরি করব না-বাড়ির ছাদে একটা বিশাল পাখির খামার করব, যেখানে দেশি-বিদেশি নানা জাতের পাখি থাকবে।’
৬০ বছর বয়সী এরশাদ মিয়া কৃষি ব্যাংকে কর্মরত। চাকরির পাশাপাশি তিনি শখের বসে ঘুঘু পাখি পালন করেন। পাঁচটি পাখি বিক্রির উদ্দেশ্যে হাটে এসেছেন। প্রচণ্ড রোদে খাঁচা হাতে নিয়ে এইদিক, ওইদিক হাঁটাহাঁটি করছেন। কাছে গিয়ে এই বয়সেও পাখি পালন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একজোড়া ঘুঘু পাখি নিয়ে আসি। সেগুলো খাঁচায় রেখে পালতে শুরু করি। ধীরে ধীরে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এলে তাদের উপহার হিসেবে ঘুঘু দেই। আবার মাঝে মধ্যে হাটে এনে বিক্রিও করি।’
এরশাদ মিয়া এ হাটে ঘুঘু বিক্রি করেন জোড়া ২৫০ টাকায়। পাখির প্রতি তার ভালোবাসা মূলত ঘুঘুর সুমধুর ডাক থেকেই শুরু। অফিস শেষে বাসায় ফিরে পাখিদের পরিচর্যায়ই কাটে এরশাদ মিয়ার অবসর সময়।
একটি বা দুটি খাঁচায় পাখি নিয়ে অনেকেই বিক্রি করতে আসেন এ হাটে
রবিনের বয়স ১০, তার বাবা গার্মেন্টসে চাকরি করেন। বাবা ও ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে পাখির হাটে। ছোট্ট এই বয়সেই পাখির প্রতি তার গভীর ভালোবাসা। তার চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস আর কৌতূহল-নতুন পাখিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আনন্দে।রবিন বলেন, ‘পাখি পালন করতে খুব ভালো লাগে। বাসায় এখন তিনটা বাজরিগার পাখি আছে। ওদের আমি খুব যত্ন করে খাওয়াই। নতুন নতুন পাখি দেখতে ও কিনতে প্রায়ই হাটে আসি। আজও এসেছি কিছু নতুন পাখি আর তাদের খাবার কিনতে।’
হাটে এদিক, সেদিক ঘুরাঘুরি করতে করতে দেখা হয় এক শৌখিন পাখি পালনকারীর সঙ্গে। দেখা যায়-পাখি কিনতে দরকষাকষি করছেন তিনি। কথা বলে জানা যায়, নাম মোরদেদুল হক, ঢাকার বাংলামোটরের স্থানীয় বাসিন্দা ও পেশায় চাকরিজীবী। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই ২০০১ সালে শখের বসে কবুতর পালন শুরু করেন।
তিনি জানান, ‘কবুতর রাখার জন্য তার রয়েছে লোহার তৈরি বড় খাঁচা, যেখানে ১৫০টি কবুতর রাখা সম্ভব। তবে বর্তমানে তার সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি কবুতর, যার বেশিরভাগই ‘রেসার’ জাতের। প্রতি সপ্তাহেই হাটে আসেন তিনি, যেখানে নিজের পালিত কবুতর বিক্রি করেন। কখনো কখনো দামে মিললে নতুন কবুতরও কিনেন।’
মোরদেদুল হক বলেন, ‘খরচ বাদ দিলে খুব তেমন লাভ থাকে না, কিন্তু ভালোবাসা থেকেই করে যাচ্ছি। হাটে আমার মতো অনেকেই আছেন যারা নিজের পাখি বিক্রি করেন, আবার নতুন পেলে কেনেন। তবে পেশাদার যারা এই কাজ করেন, তারা অবশ্য ভালোই দাম পান। বেশি দাম পেতে হলে পাখির পরিচর্যা, স্বাস্থ্য ও খাবারের দিকে নিয়মিত খেয়াল রাখতে হয়।’
খাঁচায় পাখি নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন ৬০ বছর বয়সী এরশাদ মিয়া
তার মতে, শখের এই কবুতর পালন শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, মানসিক প্রশান্তির একটি বড় উৎস। প্রতিদিন অফিসের কাজের পর যখন কবুতরের খাঁচায় যান, তখন সব ক্লান্তি ভুলে যান। তাই লাভ-লোকসানের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে পাখির প্রতি ভালোবাসা।
হাট থেকে বের হওয়ার আগেই চোখে পড়লো এক চমকপ্রদ দৃশ্য। এক বিক্রেতার কাঁধে বসে আছে একটি পাখি, আর হাতে ধরে রেখেছেন আরেকটি। এই অবস্থাতেই তিনি হাসিমুখে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক মজার পরিবেশ-অনেকেই মোবাইলে ছবি তুলছেন, কেউ কেউ ভিডিও করছেন।
সেই পাখি বিক্রেতার নাম মেহেদী হাসান শুভ, বয়স ২৭। রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের নবাবগঞ্জ বাজারে তার একটি পাখির দোকান রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই পাখির প্রতি তার গভীর আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই তিনি যুক্ত হয়েছেন পাখি পালনের পেশায়, যা পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে একটি সফল ব্যবসায়ে।
শুভ বলেন, ‘বড় ভাইয়ের উৎসাহ ও সহায়তায় পাখির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। বর্তমানে দোকানে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো বিদেশি জাতের পাখি রয়েছে। যেখানে রয়েছে নানা প্রজাতির বাহারি ও দামি পাখি, যেগুলোর মধ্যে অনেক পাখিই মানুষের মতো করে কথা বলতে পারে। প্রতিদিন দোকান খোলা থাকলেও, প্রতি সপ্তাহে পাখি নিয়ে হাটে আসি। দোকানের চেয়ে এখানেই বেশি বিক্রি হয়। কারণ হাটে পাইকারি ও খুচরা-দুই ধরনের ক্রেতাই আসে।’
বিশেষ ভিটামিন মিশ্রিত পাখির খাবারও পাওয়া যায়
শুভর কাছে সানকনুর জাতের পাখিই বেশি দেখা যায়। দেখতে সুন্দর ও কথা বলার কারণে এই পাখি বেশ জনপ্রিয়। প্রতি জোড়া সানকনুর বিক্রি করেন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকায়। শুধু বড় পাখিই নয়, বাচ্চাও বিক্রি করেন তিনি। এই পাখির দাম লাখ টাকা পর্যন্ত দাম হয়।
ব্যবসার আয়-ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এই তরুণ বলেন, মাসে গড়ে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার পাখি বিক্রি হয়। সব খরচ বাদে লাভ থাকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া অনলাইনেও পাখি বিক্রি করি। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা যোগাযোগ করেন।
কেএসকে/এএসএম