শিশুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা: বিচারহীনতায় বাড়ছে সহিংসতা

4 hours ago 5

সাফিনাতুন জাহান সাবরিন

শিশুদের বলা হয় আগামীর ভবিষ্যৎ। অথচ আমাদের সমাজে আজ তারা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দায়িত্বশীলদের মাধ্যমেই লাখ লাখ শিশু সহিংসতার শিকার হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বর্তমানে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে মাগুরায় এক শিশুর ধর্ষণ ও নির্মম মৃত্যু। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বোনের স্বামী ও শ্বশুরের দ্বারা সে ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর কয়েকদিন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বিদায় জানায়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ শিশু তার আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের দ্বারাই যৌন সহিংসতার শিকার হয়। নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। এসব ঘটনা অনেক সময় প্রকাশ্যে আসে না বা পত্রিকায় খবর হয় না, কিন্তু সমাজের প্রতিটি স্তরে শিশুদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। অনেক শিশু ভয়ভীতি ও লজ্জার কারণে এসব ঘটনা প্রকাশ করতে পারে না।

শিশু অধিকারকর্মীদের মতে, নিকটাত্মীয়দের প্রতি পরিবারের যে অন্ধবিশ্বাস, সেটিই শিশুর জন্য ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনে। মামা, চাচা, খালু, দাদা কিংবা এমনকি নিজ পিতার হাতেও নির্যাতনের শিকার হয় অনেক শিশু। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ১০ বছরের একটি শিশু নিজের বাবার দ্বারাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চরম দৃষ্টান্ত।

অনেকেই মনে করেন, শুধু মেয়ে শিশুরাই যৌন সহিংসতার শিকার হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ছেলে শিশুরাও ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তবে সামাজিক ট্যাবুর কারণে এসব ঘটনা অনেক সময় প্রকাশ পায় না।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও ছেলে শিশু ধর্ষণের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ বিভিন্ন মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও বহু ছেলে শিশু নিয়মিত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (এএসকে) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, মামলা হয়েছে ২৪টি, এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩টি।

অন্যদিকে, ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১১ জনে ১ জন ছেলে শিশু শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

শিশু নির্যাতনের ঘটনা বারবার ঘটলেও দোষীদের যথাযথ শাস্তি হয় না। বিচারহীনতা এবং জবাবদিহিতার অভাবের কারণেই এই পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

মেয়ে শিশুদের জন্য কিছু আইন থাকলেও ছেলে শিশুদের সুরক্ষার জন্য কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। তাই ছেলে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ছেলে শিশুদের সুরক্ষার জন্য স্পষ্ট আইন তৈরি করতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। শিশুদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে এবং নিকটাত্মীয়দের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে।

শিশুদের ভালো ও খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে শেখাতে হবে। যে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা যেন তারা অভিভাবকদের জানায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে যৌন নির্যাতন ও প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশুদের আত্মরক্ষা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়, বরং পরিবার ও সমাজের সকলের দায়িত্ব। শিশুদের প্রতি যে কোনো সহিংসতা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব।

আরও পড়ুন

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্টসিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম

কেএসকে/এমএস

Read Entire Article