মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর রাজ্যের সেমেনিয়েহ এলাকায় একটি দুই লেনের গ্রামীণ সড়ক আলোয় ঝলমল করছিল। তবে তা বৈদ্যুতিক ল্যাম্পপোস্টের আলোয় নয়—বরং রাস্তার ওপর ব্যবহার করা হয়েছিল এক বিশেষ ফোটোলুমিনেসেন্ট রঙ, যা সূর্যের আলো শোষণ করে রাতে নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে রাস্তাকে সুদৃশ্য করে।
এই রঙের আলো সূর্যাস্তের পর প্রায় দশ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলে থাকে। ২৪৫ মিটার দীর্ঘ ওই সড়কটি মালয়েশিয়ার জনপথ বিভাগের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ছিল—আলোবিহীন বা বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা।
মালয়েশিয়ায় প্রতি বছর ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান—এর অধিকাংশই ঘটে অন্ধকার বা অপর্যাপ্ত আলোযুক্ত সড়কে। তাই উদ্যোগটি প্রথমে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।
প্রথমদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। দ্য স্ট্রেইটস টাইমস–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃষ্টির সময় ও কুয়াশায় চালকরা এই ঝলঝলে দাগগুলোর দৃশ্যমানতা দেখে সন্তুষ্ট হন। একজন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী রসিকতা করে লেখেন, ‘মালয়েশিয়ার রাস্তা এখন সত্যিই আলোকিত’।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সড়কে আলো ও দৃশ্যমানতার ঘাটতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। খোদ রাজধানীর রাস্তায় নেই কোনো লেন মার্ক! গ্রামীণ সড়ক ও উপজেলা সংযোগ সড়কে লেন মার্ক এবং খুব কম সড়কে ল্যাম্পপোস্ট থাকলেও সেগুলো জ্বলে না।
বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে প্রতি বছর ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, যার উল্লেখযোগ্য অংশই ঘটে রাতে বা অন্ধকারে।
রাস্তার দাগ ফিকে, অজায়গায় সাইনবোর্ড স্থাপন অন্যতম সমস্যা কারণ এমন জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো আছে যা চালক দেখার আগেই ভুল রাস্তায় চলে যায়। সাধারণত যেখানে অন্য রাস্তায় যেতে হবে তার থেকে ৫০০ মিটার, ৩০০ মিটার এবং ১০০ মিটার দূরে স্পষ্ট সাইনবোর্ড থাকে কিন্তু বাংলাদেশে একেবারে যেখানে অন্য রাস্তায় যেতে হবে ঠিক সেখানে সাইন বোর্ড লাগিয়ে রেখেছে ফলে হার্ড ব্রেক করতে হয় যা দুর্ঘটনার কারণ।
অন্যদিকে অধিকাংশ সাইন বোর্ড পুরনো, রঙ ওঠা, ভাঙা বা ক্ষতিগ্রস্ত—ফলে চালকদের জন্য অনেক সময় পথচেনাই কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এবং হরেক রকমের যানবাহন চলাচল করে, মানুষ হাটে, হাটবাজার ইত্যাদি রাস্তায় চলে সেখানে মালয়েশিয়ার এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য এক চিন্তার বিষয় উত্থাপন করে—কম ব্যয়ে, বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় এমন প্রযুক্তি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব কি না।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় সরকার এরই মধ্যে ডিজিটাল রোড সেফটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোটোলুমিনেসেন্ট রঙ বা সৌরচালিত আলো ভবিষ্যতে টেকসই সমাধান হতে পারে—যদি তা কম খরচে ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রয়োগ করা যায়।
নেদারল্যান্ডস ও জাপানে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছেই। ডেলফট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ম্যানেজমেন্ট কম খরচে ও পরিবেশ সহনশীল রঙ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে।
তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় মালয়েশিয়ার ‘অন্ধকারে জ্বলা রাস্তা’ প্রকল্প আর গ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অব রোড সেফটি রিসার্চ জানিয়েছে, বর্ষা ও আর্দ্রতার কারণে এই রঙ দ্রুত ম্লান হয়ে যায়, ফলে ১৮ মাসের মধ্যেই পুনরায় রং করতে হয়। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ সড়কের অন্ধকার দূর করার উপায় আরো সহজ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল দেশে নাগরিকের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে গবেষণা চালিয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করেন।
এমআরএম/এএসএম