এ বছর সাহিত্যে নোবেল পান হাঙ্গেরীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও চিত্র্যনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। তার এ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্যারিস রিভিউর উপদেষ্টা সম্পাদক অ্যাডাম থারওয়েল। এটি প্রকাশিত হয় দ্য প্যারিস রিভিউয়ের ২০১৮ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যায়। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন কবি নকিব মুকশি—
অ্যাডাম থারওয়েল: চলুন, আপনার লেখকজীবনের শুরুটা নিয়ে আলাপ করি—
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি তখন ভাবতাম, প্রকৃত জীবন, সত্যিকারের জীবন আসলে অন্য কোথাও আছে। আমার কাছে তখন বাইবেলের মতো ছিল ফ্রান্ৎস কাফকার ‘দ্য ক্যাসল’ আর ম্যালকম লাওরির ‘আন্ডার দ্য ভলকানো’ বই দুটি। সময়টা ছিল ষাটের শেষ আর সত্তরের শুরুর সন্ধিক্ষণ। আমি পুরোপুরি লেখকজীবন গ্রহণ করতে চাইনি। ভেবেছিলাম, কেবল একটি বই লিখবো, এরপর অন্য কিছু করবো, বিশেষ করে সংগীত নিয়ে। আমি খবু দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে বাস করতে চেয়েছিলাম। ভাবতাম, সেটাই প্রকৃত জীবন। আর খুব দরিদ্র একটি গ্রামে থেকেছিও। সব সময় নিম্নমানের চাকরি-বাকরি করেছি। বাধ্যতামূলক সামরিক কাজ করার হাত থেকে পালাতে প্রতি তিন-চার মাস পরপর জায়গা বদল করতাম।
আর যখনই কিছু ছোটখাটো লেখা প্রকাশ করতে শুরু করলাম, পুলিশ থেকে ডাক এলো। হয়তো আমি একটু বেশিই অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতাম। ফলে প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের পর বলতাম, ‘দয়াকরে বিশ্বাস করুন, আমি রাজনীতি নিয়ে কিছু বলি না।’ তারা বলল, ‘আপনার সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’ আমি বললাম, ‘না, আমি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি না।’ তারা বলল, ‘আমরা বিশ্বাস করি না।’ কিছুক্ষণ পর আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম, ‘আপনারা কি সত্যিই ভাবেন, আমি আপনাদের মতো লোকদের নিয়ে কিছু লিখবো?’ এতে তারা রেগে গেল এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা সিক্রেট পুলিশ আমার পাসপোর্ট কেড়ে নিতে চাইলো। সোভিয়েত যুগের কমিউনিস্ট শাসনকালে আমাদের দুটি পাসপোর্ট ছিল—নীল আর লাল। আমারটি ছিল লাল। লাল পাসপোর্ট তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ সেটা দিয়ে শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যাওয়া যেত। আর নীল মানে ছিল যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা। আমি বললাম, ‘আপনারা সত্যিই লালটা নিতে চান?’ তবু তারা সেটাই নিয়ে নিলো। ফলে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমার কোনো পাসপোর্টই ছিল না।
এটাই ছিল আমার লেখকজীবন শুরুর গল্প, আর সহজেই এটি শেষ গল্পও হতে পারতো। সম্প্রতি সিক্রেট পুলিশের নথিতে আমি এমন কিছু নোট পেয়েছি, যেখানে তারা সম্ভাব্য গুপ্তচর বা তথ্যদাতাদের নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা লিখেছে, আমার ভাইকে গুপ্তচর বা তথ্যদাতা হিসেবে রাজি করানো সম্ভব ছিল, কিন্তু লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই অসম্ভব। কারণ তিনি ঘোর কমিউনিস্টবিরোধী। এখন এটা হাস্যকর মনে হয়, কিন্তু তখন মোটেই হাস্যকর ছিল না। তবে আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিইনি। আমি শুধু ছোট ছোট গ্রাম আর শহরে থেকেছি আর লিখতেছিলাম আমার প্রথম উপন্যাস।
থারওয়েল: উপন্যাসটি কীভাবে প্রকাশ করলেন?
ক্রাসনাহোরকাই: সময়টা ১৯৮৫। কীভাবে ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ প্রকাশিত হয়ে গেল কেউই বুঝতে পারেনি, এমনকি আমি নিজেও। কারণ এটি কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য মোটেই সুবিধাজনক উপন্যাস ছিল না। তখন সমসাময়িক সাহিত্য প্রকাশের একটি প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক ছিলেন একজন সাবেক গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান। উপন্যাসটি প্রকাশ করে হয়তো তিনি নিজের ক্ষমতা ও সাহস জাহির করতে চেয়েছিলেন। আমার ধারণা, এটাই ছিল বইটি প্রকাশের একমাত্র কারণ।
থারওয়েল: আপনি তখন কী ধরনের কাজ করতেন?
ক্রাসনাহোরকাই: আমি কিছুদিন খনিশ্রমিক ছিলাম। কাজটা ছিল প্রায় হাস্যকর, আসল খনিশ্রমিকদের সুরক্ষায় আমি নিয়োজিত ছিলাম। তারপর আমি বিভিন্ন গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক হলাম। প্রতিটি গ্রামে একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে মানুষ ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়তে পারতো। এটাই ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনের একমাত্র পাঠাগার। শুক্রবার বা শনিবার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক একটি সংগীতানুষ্ঠান বা কিছু একটা আয়োজন করতেন। এটা তরুণদের জন্য বেশ ভালো উদ্যোগ ছিল। আমি ছয়টি ছোট গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ছিলাম, মানে আমাকে সব সময় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হতো। এটা ছিল দারুণ একটি চাকরি। আমার খুব ভালো লাগতো। কারণ এতে আমি আমার বুর্জোয়া পরিবার থেকে অনেকটা দূরে ছিলাম।
আর কী করেছি? আমি তিনশ গরুর রাত্রিকালীন পাহারাদার ছিলাম। কাজটা উপভোগ করতাম, কারণ গোয়ালঘরটি ছিল জনমানবহীন নিঝুম এক খোলা জায়গায়। আশপাশে কোনো গ্রাম, শহর বা নগর ছিল না। আমি কয়েক মাস ছিলাম সেখানে। সে সময় আামর এক পকেটে ‘আন্ডার দ্য ভলকানো’, অন্যটায় দস্তয়েভস্কি নিয়ে গরিবি এক জীবন কাটিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: প্রেম ও প্রতিবাদের কবি
সৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে
যাযাবর জীবনের এ সময় আমি মদ্যপান শুরু করি। হাঙ্গেরীয় সাহিত্যে একটা ঐতিহ্য ছিল, সত্যিকারের প্রতিভাবানেরা সবাই মদ খেত। আমিও তখন মদপান করে মাতাল হয়ে থাকতাম। একদিন একটা ব্যাপার ঘটলো, হাঙ্গেরীয় একটা লেখক দলের সঙ্গে বসে আলাপকালে তারা বলে বসল, হাঙ্গেরীয় কোনো প্রতিভাবান মানেই মদ্যপায়ী। আমি এটা মানতে নারাজ। বারো বোতল শ্যাম্পেনের বাজি ধরলাম যে, আমি আর কখনো মদপান করবো না।
থারওয়েল: তারপর আর আপনি মদ খাননি?
ক্রাসনাহোরকাই: না, আর খাইনি। তখন সমসাময়িক গদ্যলেখকদের মধ্যে পেতার হাইনোচি নামের একজন লেখক ছিলেন। তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি, আর চূড়ান্ত মদ্যপ ঠিক ম্যালকম লাওরির মতো। তাঁর মৃত্যু ছিল হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তখন তিনি তরুণ ছিলেন, বয়স সম্ভবত চল্লিশ।
সে সময় কোনো কিছু নিয়েই চিন্তিত থাকতাম না। সে এক রোমাঞ্চকর জীবন—সব সময় এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া, রাতের রেলস্টেশন আর বারে বসে মানুষদের পর্যবেক্ষণ করা, তাদের সঙ্গে ছোট ছোট আলাপে মজা। এই ছিল আমার জীবন। সে সময় ধীরে ধীরে মাথাতেই বইটির লেখা সাজাতে থাকি। কাজটা ছিল উপভোগ্য। কারণ আমার মনে হতো সাহিত্য এক আত্মিক, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র। সে সময় হাইনোচি, ইয়ানোস পিলিনস্কি, শানদর ভ্যোরেশসহ আরও কিছু অসাধারণ কবি ছিলেন। তাঁরা নিয়মিত লিখতেন। তখন গদ্যসাহিত্য তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী ছিল। আমরা কবিতাকে বেশি ভালোবাসতাম। কারণ তা ছিল বেশি রহস্যময়, বেশি আকর্ষণীয়। গদ্য ছিল বাস্তবতার খুব কাছাকাছি। সে সময় একটা ধারণা ছিল, গদ্যসাহিত্যের কোনো প্রতিভাবান মানেই তিনি বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি থাকেন। এ কারণেই ঐতিহ্যগতভাবে জিগমন্দ মরিৎসের মতো হাঙ্গেরীয় গদ্যলেখকেরা ছোট ছোট বাক্যে লিখতেন এবং তা ছিল বেশ পরিপক্ব। হাঙ্গেরীয় গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে আমার একজন প্রিয় লেখক আছেন, নাম জুলা ক্রুদি। এক অসাধারণ লেখক। তার লেখা অনুবাদ করা বেশ কঠিন। হাঙ্গেরিতে তিনি ছিলেন এক দোন জোভাননি—দুই মিটার লম্বা, বিশাল এক মানুষ, এক অসাধারণ চরিত্র। তিনি এতটাই আকর্ষণীয় চরিত্রের ছিলেন যে কেউই তাঁর মায়াটান থেকে দূরে থাকতে পারতো না।
থারওয়েল: আর তাঁর লোখাজোখা?
ক্রাসনাহোরকাই: অন্য সব গদ্যলেখকের চেয়ে তার টেক্সট ছিল ভিন্নরকম। তার লেখা হালকা মদপান করা ব্যক্তির মতো বিষণ্ন, জীবনের প্রতি যার কোনো মোহ নেই, যার ভেতরে প্রবল শক্তি আছে, কিন্তু সেটা যেন নিষ্প্রয়োজনের মতো পড়ে আছে। তবে ক্রুদি আমার কাছে কোনো সাহিত্যিক আদর্শ ছিলেন না। তবে আমার লেখার শুরুর দিকে তিনি শক্তি-সাহস জুগিয়েছিলেন।
ইয়ানোস পিলিনস্কি ছিলেন আমার আরেক প্রিয় লেখক। তার ভাষা, গল্প বলার ধরন আমার কাছে তাকে গুরুত্বপর্ণ করে তোলে। আমি অনুকরণ করার চেষ্টা করব:
প্রিয় অ্যাডাম—আমরা—অপেক্ষা—করবো না—কোনো প্রলয়ের জন্য, আমরা এখনই—প্রলয়ের মধ্যে—বেঁচে আছি।—আমার প্রিয়—অ্যাডাম—দয়াকরে কোথাও—যেও না—কোথাও...
বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে উচ্চস্বর-নিম্নস্বর, ঊর্ধ্বগতি-ধীরগতি—এই ঢেউ চলে বিরতি দিয়ে দিয়ে। আর প্রতিটি শব্দের শেষ অক্ষর খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়।
পিলিনস্কি এমন এক লেখক, যেন কোনো গুহাসমাধির পুরোহিত, যার ভেতরে কোনো আশা নেই, অথচ বিপুল আশার অনুরণনের মধ্যে বাস করছেন। তবে তিনি ক্রুদি থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন। তিনি ছিলেন যেন একটি মেষশাবক, মানুষ নন।
(সংক্ষেপিত)
এসইউ/জিকেএস