সামগ্রিক উন্নয়নে এগিয়ে যাক নারী, এটাই প্রত্যাশা

2 hours ago 5

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’- কবির এই পঙক্তির মর্মকথা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে নারী-পুরুষের সমান ও অবিচ্ছেদ্য ভূমিকার কথাই মূলত বলা হয়েছে। বাস্তবেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বলি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলি, এসবের পেছনে বড় শক্তিগুলোর একটি হলো নারীসমাজ এবং তাদের শ্রম। একসময় ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকা নারীরা সময়ের হাত ধরে আজ দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। গার্মেন্টস শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক-বীমা, তথ্যপ্রযুক্তি- সব ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ সমভাবে দৃশ্যমান। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, আমাদের জাতীয় আয়ে নারীর শ্রমের অবদান যথাযথভাবে আজও মূল্যায়িত হয় না। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র- তিন স্তরেই নারী শ্রম এখনও বৈষম্যের শিকার। বলা যায়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিত্রে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও- সেটি অনেক সময় স্বীকৃত নয় এবং প্রাপ্য মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত।

শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। নারী শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়নই নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে। একজন শিক্ষিত মা পরিবারকে সচেতন করে, সন্তানদের আলোকিত করে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন। ফলে নারীশিক্ষা আজ মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। কৃষি, পশুপালন, মৎস্যচাষ, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কার্যক্রমেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে নারীর অংশগ্রহণ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এতে আর্থিক স্বাধীনতা যেমন বেড়েছে, একই সঙ্গে পরিবার ও সমাজে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক উন্নয়নেও নারীর ভূমিকা অনন্য। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু লালন-পালনে নারীর সচেতনতা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে। রাজনীতি ও নেতৃত্বে নারী শক্তি বাংলাদেশকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী নেতৃত্ব দেশের রাজনীতিকে নতুনমাত্রা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে তৃণমূল পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারী উদ্যোক্তারা ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং এবং ডিজিটাল ব্যবসায় কর্মসংস্থান তৈরি করছে।

সাফল্যের ঝুঁড়িতে এত অবদানের পরও সবচেয়ে বড় অবহেলার জায়গা হলো ঘরে নারীদের শ্রমের অবদানগুলো। রান্না, সন্তান লালনপালন, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সেবা, গৃহস্থালির নানা কাজ- এসবই দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অপরিহার্য অংশ। যদি এ কাজগুলো বাজারমূল্যে হিসাব করা হতো, তাহলে জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যানে নারীর অবদান আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র হিসাব অনুযায়ী, গৃহস্থালির কাজকে অর্থনৈতিক অবদান হিসেবে গণনা করলে অনেক দেশের জিডিপি কয়েক শতাংশ বেড়ে যায়। অথচ বাংলাদেশে এখনও এসব শ্রমকে অদৃশ্য বলা হয়, কারণ এর বিনিময়ে নারীরা কোনো অর্থ পান না। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলো তৈরি পোশাক শিল্প, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে, এর মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশই নারী। এ খাত থেকে বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে, তার বড় অংশই নারী শ্রমের অবদান। কিন্তু একইসাথে প্রশ্ন ওঠে- এই শ্রমিকরা কি ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ নারী শ্রমিক এখনও বেতন বৈষম্য, হয়রানি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার। কৃষি খাতেও নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বীজ বপন, চারা রোপণ, শস্য কাটাসহ নানা কাজে নারীরা পরিশ্রম করে, অথচ কৃষি শ্রমিক হিসেবে তাদের নাম সরকারি পরিসংখ্যানে উঠে আসে না। গ্রামের নারী কৃষকরা পরিবার ও সমাজের কাছে ‘সহযোগী’ হিসেবে পরিচিত থাকেন, প্রকৃত কৃষক হিসেবে নয়। ফলে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের দাবি-দাওয়া গুরুত্ব পায় না।

এত বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তির পরও দেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান স্বীকৃত বিষয়। শুধু পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন না বরং সামষ্টিক অর্থনীতির এক অপরিহার্য চালিকাশক্তি হয়ে উঠছেন। বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে এখন জাতীয় প্রবৃদ্ধির কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে এই উদ্যোক্তারা। তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ব্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণ অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ডিপোজিটে নারীদের অবদান প্রায় অর্ধেকের ঘরে পৌঁছেছে। এ ছাড়া নারীদের ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট ও ঋণ অ্যাকাউন্ট উভয়ই বছরে ১৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু একই সময়ে ব্যাংকিং খাতের মোট কর্মীসংখ্যার মধ্যে নারীর উপস্থিতি মাত্র ১৬-১৭ শতাংশ। অর্থাৎ নারীরা গ্রাহক হিসেবে সামনে এলেও ব্যাংকের ভেতরে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ভূমিকায় তাদের উপস্থিতি এখনও সীমিত। এটা হতাশার চিত্র। এ কারণে নারী উদ্যোক্তাদের চাহিদাভিত্তিক আর্থিক সেবা ডিজাইন করতে অনেক ব্যাংকই পিছিয়ে আছে। বহু নারী উদ্যোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলেও নিয়মিত লেনদেন হয় না। অনেক সময় তারা ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের শর্তে আটকে যান। ডিজিটাল ব্যাংকিং ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার নিয়ে ভীতি কাজ করে, প্রশিক্ষণের অভাবে। আবার অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা নারী উদ্যোক্তার ব্যবসার সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে চান না। সামাজিক মানসিকতার প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। অনেক পরিবার এখনও মনে করে, ব্যবসা বা আর্থিক বিষয়ে নারীর সংশ্লিষ্টতা দরকার নেই। ফলে ব্যাংকের দরজা খোলা থাকলেও বাস্তবে নারীরা ভেতরে ঢুকতে দ্বিধাগ্রস্ত হন।

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আফ্রিকার কিছু দেশে মোবাইল মানির প্রসার নারীদের আয়ের ধারাকে মূলধারায় এনেছে। আগে যেখানে নারীরা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে ছিলেন এখন মোবাইল মানির মাধ্যমে তারা লেনদেন, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে পারছেন। এতে তাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন বেড়েছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে। ভারতের অভিজ্ঞতাও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। সেখানে নারী উদ্যোক্তা গ্রুপগুলোকে সমষ্টিগতভাবে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু আছে। এর ফলে পুনঃপরিশোধের হার আশ্চর্যজনকভাবে বেশি হয়েছে। শুধু তাই নয়, কেনিয়াতে এম-পেসার মতো মোবাইল ফিনটেক প্লাটফর্ম নারীদের ক্ষুদ্র ব্যবসায় দ্রুত মূলধন জোগাড়ের সুযোগ দিয়েছে। ইথিওপিয়াতে নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি খাতে নারীদের অংশগ্রহণকে বহুগুণ বাড়িয়েছে। রুয়ান্ডাতে আবার সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করে নারীদের জন্য বিশেষ উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং মার্কেট অ্যাক্সেস প্রোগ্রাম চালু করেছে। বাংলাদেশের জন্য এসব মডেল কার্যকর হতে পারে বিশেষ করে নারীদের ক্লাস্টারভিত্তিক অর্থায়ন, ডিজিটাল আর্থিক সাক্ষরতা এবং মোবাইলভিত্তিক সেবা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। আমাদের নারীরা যদি সম্মিলিতভাবে পুঁজির জোগান পান এবং ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করেন তবে তাদের ব্যবসা টেকসই হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও দৃশ্যমান প্রভাব ফেলবে।

আসলে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব এখানে বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে ফলে তারা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে স্বাবলম্বী হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা পেলে তারা ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারেন, নতুন বাজার ধরতে পারেন এবং আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পারেন। তৃতীয়ত, নারী উদ্যোক্তার অন্তর্ভুক্তি একটি টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন নারী যখন আয় করেন তখন সেই আয় কেবল পরিবারের খাদ্য বা পোশাকে ব্যয় হয় না বরং সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগেও কাজে লাগে। তাই অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বহুগুণ প্রভাব সৃষ্টি করে।

আমি মনে করি, নারী উদ্যোক্তার আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কোনো অনুকম্পা নয়, এটা অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা উচিত। বাস্তবে দেখা গেছে, নারী উদ্যোক্তারা যখন ক্ষমতায়িত হন তখন তাদের ব্যবসা বড় হয়, কর্মসংস্থান তৈরি হয়, পরিবার স্বাবলম্বী হয়, সমাজ সমৃদ্ধ হয়। যদি আমরা সঠিক নীতি, প্রযুক্তি ও সামাজিক সহযোগিতা একসঙ্গে দিতে পারি, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি আর অর্ধেক থাকবে না। পুরোটা হয়ে উঠবে আমাদের প্রবৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য প্রত্যাশা।

এক কথায় দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রকে নারীশিক্ষায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর অধিকার রক্ষা করতে হবে। একইসঙ্গে সমাজকে নারীর অবদানকে সম্মান জানাতে হবে এবং পরিবার পর্যায়ে ছেলে-মেয়ের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীসমাজ কেবল ভুক্তভোগী নয়, বরং উন্নয়নের সহযাত্রী। বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণই প্রমাণ করে যে- উন্নয়ন ও নারী একে অপরের পরিপূরক। নারীর পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ আরও অগ্রসর হবে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে। নারী সমাজের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে নারীর প্রতি আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং উন্নয়নের মূলধারায় তাদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণই হবে আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশ। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নারীর এই অগ্রযাত্রা এগিয়ে যাক-এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : কলাম লেখক ও শিল্প-উদ্যোক্তা

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article