• অপারেশনের অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে বরাদ্দের টাকা লুট
• ওটি যন্ত্রপাতি মেরামত বাবদ প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ
• অতিরিক্ত বরাদ্দের ওষুধ উধাও
• হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ
• আইভি ক্যানোলা কেনায় হয়েছে দুর্নীতি
• আয়া-পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতনেও ভাগ বসান কর্মকর্তারা
অপারেশন থিয়েটারের অবস্থা অকেজো। গত পাঁচ বছরে অপারেশন হয়েছে অর্ধশতাধিক। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ছোট-বড় মিলে অপারেশন করা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার! অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতির মেরামত বাবদ খরচ দেখিয়েও তছরুপ করা হয়েছে সরকারি অর্থের।
শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত বরাদ্দের সরকারি ওষুধের চিহ্ন নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নামমাত্র ওষুধ বিতরণ করা হলেও তার পুরোটাই মেয়াদোত্তীর্ণ। আয়া-সুইপারদের বেতনের অংশেও ভাগ বসান সরকারি কর্মকর্তারা। এমন কোনো দুর্নীতি নেই যা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হয় না। শুধু এই একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই গত পাঁচ বছরে অন্তত চার কোটি টাকা এমন ভুয়া খরচ দেখিয়ে লোপাট করার তথ্য এসেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নিপার বিরুদ্ধে এভাবে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। তার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে প্রধান সহকারী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
অপারেশন না হলেও ওটি খরচ কোটি টাকা
সম্প্রতি দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখা যায়, অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা অপারেশন থিয়েটারটি অকেজো। ধুলার আস্তরণ পড়েছে যন্ত্রপাতির গায়ে। বেডটিও নাজুক। দেখেই বোঝা যায়, এখানে গত কয়েক বছরে কোনো রোগীর অপারেশনই হয়নি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ফারহানা ওয়াহিদ তানি জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় অপারেশন বন্ধ রয়েছে। ৫ বছর আগে তিনি যোগদান করার পর হাতেগোনা কয়েকটি অপারেশন হয়েছে। যেগুলো তিনি নিজেই করেছেন। এরপর থেকে আর হয়নি।
অথচ হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর অসংখ্য অপারেশন করা হয়েছে। ২০২০ সালে হাসপাতালটিতে ৯টি বড় আর এক হাজার ৯৬৮টি ছোট, ২০২৩ সালে ৩৯টি বড় ও পাঁচ হাজার ৫২৯টি ছোট, ২০২৪ সালে ১৪১টি বড় ও পাঁচ হাজার ১১৭টি ছোট এবং চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬১টি বড় অপারেশন ও এক হাজার ৯১৯টি ছোট ধরনের অপারেশন করা হয়েছে। অথচ হাসপাতালের ওটি (অপারেশন থিয়েটার) রেজিস্ট্রারে গত পাঁচ বছরে অর্ধশতেরও কম অপারেশনের তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেটিও সঠিক নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অপারেশন থিয়েটারে যন্ত্রপাতি মেরামত বাবদ তিন লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে তিন লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে আড়াই লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিন লাখ টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাড়ে সাত লাখ টাকাসহ মোট ২১ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৮ লাখ টাকাসহ মোট ৭৯ লাখ টাকার সার্জিক্যাল মালামাল ক্রয় করা হয়েছে। সবমিলিয়ে খরচ দেখানো হয়েছে কোটি টাকার ওপরে। এর বাইরেও হাসপাতালের বরাদ্দ অনুযায়ী বছরে গড়ে ২০ লাখ টাকা এসেছে ওটির যন্ত্রপাতি মেরামত ও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনী মালামাল কেনার জন্য। এছাড়া, অপারেশনের জন্য বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন ধরনের সুতা ও স্পাইনাল নিডল চোখের পলকেই গায়েব হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ মোহাম্মদ শাহজাহান আলী বলেন, ‘পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অপারেশন করা সম্ভব হয় না। যে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয় সেটি মূলত স্কোর বাড়ানোর জন্য।’
সরকারি ওষুধের অতিরিক্ত বরাদ্দ লোপাট
গত পাঁচ বছরে দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ এবং অন্যান্য মালামাল কেনা হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেনা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা এবং একই বছরে হাসপাতালটিতে অতিরিক্ত ওষুধের বরাদ্দ এসেছে সাড়ে ৪৫ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৪৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং একই বছরে হাসপাতালটিতে ওষুধের অতিরিক্ত বরাদ্দ এসেছে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ সালে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং ২০২৪-২৫ সালে ৬০ লাখ টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ওষুধ পরিবহন ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। কাগজে কলমে প্রতি বছর এমন হিসাব কষা হলেও বাস্তবে এসব ওষুধ ও মালামাল কোনো বছরেই হাসপাতালে এসে পৌঁছায়নি। এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হাসপাতালটিতে ২০জি ও ২২জি সাইজের আইভি ক্যানোলা কেনা হয় ২০ হাজার। যার প্রতি পিসের মূল্য ৩৭.৯৯১ টাকা। ২০ হাজার ক্যানোলার মূল্য প্রায় আট লাখ টাকা। অথচ কেনা হয়েছে ১৮জি ধরনের ক্যানোলা। ১৮জি ক্যানোলার প্রতি পিসের মূল্য ২০ টাকা। অর্থাৎ বাজেটের অর্ধেক টাকাই গেছে কর্মকর্তদের পকেটে।
আরও পড়ুন:
- দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ
- চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে হদিস নেই বরাদ্দের ২৪ লাখ টাকার
- রাজশাহীতে একমাত্র বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তালা
- হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে হাসপাতালেই বিয়ে
- কুমিল্লায় অস্ত্রোপচারে জোড়া লাগলো বিচ্ছিন্ন হাত, পাচ্ছেন অনুভূতি
মাইক্রোপোর টেপ কেনাতেও হয়েছে দুর্নীতি। চলতি অর্থবছরে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় দুই কোটি টাকার ওষুধ বরাদ্দের অনুমোদন মিলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। সেখান থেকে প্রায় ৭৭ লাখ টাকার ওষুধের দরপত্র আহ্বান করা নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
বরাদ্দের ওষুধ পান না রোগীরা
সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হাসপাতালটিতে ঠান্ডাজনিত রোগের ওষুধ মন্টিলুকাস-১০ ট্যাবলেট বরাদ্দ আসে সাড়ে ৪৬ হাজার পিস। যার প্রতি পিসের মূল্য ১৬.৯৯১ টাকা। যার মোট খরচ দাঁড়ায় আট লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, সে ওষুধ পাননি রোগীরা। ‘নিউট্রাম গোল্ড’ নামে ভিটামিন বিতরণ করা হলেও তা ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।
হাসপাতালটির ফার্মাসিস্ট ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসব ওষুধ (মেয়াদোত্তীর্ণ) রোগীদের মাঝে বিতরণ করতে চাইনি। হাসপাতালের স্টোরকিপার কাম বড়বাবু (প্রধান সহকারী) হুমায়ুন কবির আমাকে বাধ্য করেছেন।’
এ বিষয়ে হাসপাতালের প্রধান সহকারী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মৌখিক নির্দেশে ফার্মাসিস্টকে কম সময়ের মেয়াদি ওষুধ বিতরণ করতে বলা হয়েছে।’
অন্যদিকে কুড়ালগাছি সাব-সেন্টারের মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট আক্তারুজ্জামান জানান, গত দুই বছর মন্টিলুকাস ১০ ট্যাবলেট তারা বরাদ্দ পাননি।
আয়া-পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতনে থাবা
নথি বলছে, একজন আয়ার দৈনিক মজুরি ৪৫০ টাকা। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মজুরি ৫০০ টাকা। কিন্তু মাসে আয়াকে বেতন দেওয়া হয় মাত্র দুই হাজার টাকা। পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দেওয়া হয় ছয় হাজার ৫০০ টাকা। বাকি টাকা যাচ্ছে কর্মকর্তাদের পকেটে।
হাসপাতালের বেডশিট, বালিশের কভার, ম্যাট্রেস, কম্বলসহ নানা প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটাতেও হয়েছে অনিয়ম। দায়িত্বপ্রাপ্ত আয়া সেলিনা খাতুন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী সনি জানান, দৈনিক হাজিরায় তারা টাকা বেতন পান না। তাদের মাস শেষে দুই হাজার ও সাড়ে ছয় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। হাসপাতালে ভেষজ বাগানের জন্য বরাদ্দের তিন লাখ টাকা লুটের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব হরিলুটের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নিপা। তার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে সাবেক প্রধান সহকারী হাসান আহমেদ, বর্তমান প্রধান সহকারী হুমায়ুন কবির এবং সাবেক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মোস্তফা জামাল শুভ।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হেলেনা আক্তার নিপা বলেন, ‘অপারেশন থিয়েটারের ব্যাপারে সব তথ্য আমার জানা নেই। বিষয়টি না দেখে বলা সম্ভব নয়।’
ওষুধের বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চাহিদা অনুযায়ী ঠান্ডাজনিত রোগের ওষুধ মন্টিলুকাস ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর বাকি ট্যাবলেট ইউনিয়ন সাব সেন্টারে বিতরণ করা হয়।
তবে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ডা. হেলেনা আক্তার নিপা।
তবে অভিযোগের বিষয়ে সাবেক বড় বাবু হাসান আহমেদ এবং বর্তমান স্টোরকিপার কাম বড় বাবু হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘অপারেশনের যে থিউরিটিক্যাল তথ্য এবং বাস্তবে যে অপারেশন হয় না তার মধ্যে বিরাট গ্যাপ। এ বিষয়টি আশঙ্কাজনক। এটি খতিয়ে দেখা হবে।’
সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন অহমেদ বলেন, ওটি রেজিস্টার মেইনটেইন করেই অপারেশনের তালিকা লিপিবদ্ধ করতে হবে। সে অনুযায়ী প্রতিবেদন করতে হবে। এটার ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। অপারেশন না করে স্কোর বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত অপারেশন দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আওলিয়ার রহমান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ প্রায় চূড়ান্ত। তদন্তে যা পাওয়া গেছে তাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিবেদন সিভিল সার্জন বরাবর জমা দেওয়া হবে।
এসআর/এমএস