বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে কৃষিজমি ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। এক ইঞ্চি কৃষিজমিও যেন অনাবাদি না থাকে এবং অযথা নষ্ট না হয়, এটি সময়ের দাবি। কৃষিজমি রক্ষায় সরকার এরই মধ্যেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথমত, কৃষিজমি নষ্ট করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আসন্ন আইনে কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে, যাতে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন ও নগর সম্প্রসারণের ফলে উর্বর জমি হারিয়ে না যায়। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মিনি কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হবে। সারাদেশে ধাপে ধাপে একশ মিনি কোল্ড স্টোর স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষকেরা সহজেই তাদের ফসল সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং মৌসুমভিত্তিক দাম কমে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়, তা থেকে রক্ষা পাবেন। একই সঙ্গে ভোক্তারাও সারাবছর ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাবেন।
তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) যদি কৃষকদের জমির ওপর দিয়ে নতুন সড়ক নির্মাণ করে, তবে জমির যথাযথ মূল্য কৃষকদের প্রদান করা হবে। আর রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে অধিদপ্তর জমি অধিগ্রহণ করলে কৃষকেরা তিনগুণ মূল্য পাবেন। এতে কৃষকের জমির ক্ষতি হলেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই আইন বাস্তবায়িত হলে কৃষকেরা আর মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন না। কোল্ড স্টোরেজ ও সংরক্ষণ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত করতে পারবেন। সর্বোপরি, কৃষিজমি রক্ষা শুধু কৃষকের স্বার্থেই নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। সঠিক আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন কতটা কৃষিজমি কমছে, এ প্রশ্নের সরল, একক কোনো অফিশিয়াল সংখ্যা নেই। বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণায় পদ্ধতি ও পরিধির ভিন্নতার কারণে হারে পার্থক্য দেখা যায়। নিচে সবচেয়ে ব্যবহৃত ও সাম্প্রতিক কয়েকটি উৎসের ভিত্তিতে তথ্য-ভিত্তিক সারসংক্ষেপ তুলে ধরলাম।
আরও পড়ুন
প্রতিদিন কতটা কৃষিজমি কমছে, তার পরিসংখ্যান
প্রথম আলো (বিশ্লেষণ, ২০১৪): প্রতিদিন ৬৯২ একর কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে প্রায় ২৮০ হেক্টর/দিন।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (প্রবন্ধে উদ্ধৃত): বছরে ৬৯,৭৬০ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে রূপান্তর প্রায় ১৯১ হেক্টর/দিন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর: বছরে ২,৫০০ হেক্টর আবাদি জমি হারানো প্রায় ৬.৮ হেক্টর/দিন। উৎস ভেদে দিন-প্রতি ক্ষয় ৭ হেক্টর/দিন (খুব সীমিত গণনা) থেকে ২৮০ হেক্টর/দিন (ব্যাপক রূপান্তর হার) পর্যন্ত ওঠানামা করছে। নীতিগত আলোচনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এসআরডিআই (১৯১ হেক্টর/দিন) ও প্রথম আলো (২৮০ হেক্টর/দিন) এ দুটি উচ্চ-পর্যায়ের আনুমানিকতা বেশি ব্যবহৃত হয়।
সবচেয়ে বেশি রেঞ্জ: প্রতিদিন প্রায় ১৯০–২৮০ হেক্টর কৃষিজমি কমছে (এসআরডিআই উদ্ধৃতি ও প্রথম আলোর বিশ্লেষণ থেকে গণনা)।
অন্য প্রশাসনিক হিসাব: ডিএই-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ সংখ্যা অনেক কম প্রায় ৭ হেক্টর/দিন।
কারণসমূহ
নগরায়ণ ও অবকাঠামো: আবাসন, সড়ক, বাণিজ্যিক স্থাপনা।
শিল্পায়ন ও ইটভাটা: কৃষিজমি পরিবর্তনের বড় চালক।
নদীভাঙন/জলবায়ু ঝুঁকি: উপকূল-নদীতীরবর্তী এলাকায় স্থায়ী ক্ষয়।
কৃষিজমি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ খাদ্যনিরাপত্তা
কৃষিভিত্তিক দেশ, আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনধারা কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকটের একটি হলো কৃষিজমির দ্রুত হ্রাস। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, আবাসন প্রকল্প, ইটভাটা নির্মাণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে উর্বর কৃষিজমি প্রতিনিয়ত কমছে। ফলে শুধু কৃষি উৎপাদন নয়, দেশের খাদ্যনিরাপত্তাও হুমকির মুখে। কৃষিজমি হারালে সরাসরি কমে যায় খাদ্যশস্য উৎপাদন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, এর সাথে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদাও। জমি কমে গেলে খাদ্য উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। এতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়, আমদানিনির্ভরতা বাড়ে এবং অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি উৎপাদনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
প্রথমত, কৃষিজমি রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। যাতে অযথা জমি দখল বা শিল্পায়নের জন্য জমি নষ্ট না হয়।
দ্বিতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সীমিত জমিতে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
তৃতীয়ত, ছাদ কৃষি, উল্লম্ব কৃষি এবং জলচাষের মতো উদ্ভাবনী পদ্ধতি চালু করলে জমির ওপর চাপ কমবে।
পাশাপাশি কৃষকদের প্রশিক্ষণ, ন্যায্য বাজার মূল্য এবং সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
কৃষিজমি শুধু খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর সময় কৃষিজমি রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। বলা যায়, কৃষিজমি রক্ষা করা মানেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, কৃষক এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
এসইউ/এমএস