চিকিৎসা ও জীবনমানের উন্নয়নের কারণে দেশে দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। ২০২০ সালে যেখানে ৬০ বছর বা তার বেশি জনগোষ্ঠীর হার ছিল ১৩ শতাংশ, তা ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
এমন অবস্থায় পরিবারের অবৈতনিক নারী সদস্যদের ওপর বয়স্ক নির্ভরশীল মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। তাই স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও জেন্ডার নীতির সঙ্গে সমন্বিত একটি আনুষ্ঠানিক ও বহুমাত্রিক যত্ন কাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
দেশের জনসংখ্যার বার্ধক্য দ্রুত বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) এক উচ্চপর্যায়ের সেমিনারে দীর্ঘমেয়াদি যত্ন (এলটিসি) ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে মতবিনিময় হয়। রাজধানীর লেকশোর গ্র্যান্ড হোটেলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন সহযোগী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রথম ‘বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি যত্নবিষয়ক জাতীয় বিশ্লেষণমূলক গবেষণা (সিডিএস)’ প্রকাশ করা হয়। এটি যৌথভাবে সম্পাদন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আয়াত এডুকেশন ফাউন্ডেশন। গবেষণাটিতে নারী-পুরুষ সমতা, সাশ্রয়িতা ও জনগণকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে একটি কার্যকর ও টেকসই যত্ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রমাণভিত্তিক সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
সেমিনারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফ বলেন, ‘এই গবেষণাটি নীতিনির্ধারকদের জন্য সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের নীতিমালা আছে, তবে কেবল আয়ের সহায়তা যথেষ্ট নয়। এখন প্রয়োজন প্রশিক্ষিত সেবাদাতা, টেকসই অর্থায়ন এবং সবার জন্য সমান সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে একটি সমন্বিত যত্ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর বয়স্কদের জন্য ভাতা ও ডে-কেয়ার সেন্টারের মতো কর্মসূচি সম্প্রসারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন সময় এসেছে এসব উদ্যোগকে দীর্ঘমেয়াদি যত্নের অর্থায়ন কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করার, যাতে প্রতিটি প্রবীণ নাগরিক মর্যাদা ও যত্ন পান।’
এডিবির প্রধান সমাজ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ (সামাজিক অন্তর্ভুক্তি) ফ্রান্সেসকো টর্নিয়েরি জানান, এই গবেষণা বাংলাদেশের জনগণকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি যত্ন ব্যবস্থা গঠনে একটি বাস্তবসম্মত নীতিপথ নির্ধারণ করেছে।
আয়াত এডুকেশন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান তাহসিন আমান বলেন, ‘আমাদের উন্নতি শুধু সংখ্যা বা অর্থনীতিতে নয়, মানবিকতা ও সহানুভূতিতেও হতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি যত্নে বিনিয়োগ নৈতিক দায়িত্বের পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক সুযোগও।’
গবেষণার মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন এডিবি বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক উন্নয়ন কর্মকর্তা (জেন্ডার) নাশিবা সেলিম এবং জাতীয় প্রবীণ যত্ন পরামর্শক ও আয়াত ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান চৌধুরী। তারা জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি যত্ন নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, প্রশিক্ষিত সেবাদাতা গড়ে তোলা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা সমন্বয় এবং উদ্ভাবনী অর্থায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।
আরও পড়ুন
মাসে ১০ হাজার টাকা সম্মানী পাবেন অসচ্ছল প্রবীণ সাংবাদিকরা
প্রবীণদের সুবিধার ঘোষণা অনেক, বাস্তবায়ন নেই
নির্যাতনের শিকার প্রবীণরা: সমাজের দায়, পরিবারের ভূমিকা
সেমিনারে সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য, অর্থ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দূতাবাস, জাতিসংঘ সংস্থা, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, একাডেমিক সংগঠন ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘বাংলাদেশে টেকসই দীর্ঘমেয়াদি যত্ন ব্যবস্থার জন্য উদ্ভাবনী অর্থায়ন কৌশল’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা। এটি পরিচালনা করেন আয়াত এডুকেশন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত আমান। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি যত্ন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন। এখনই সময় উদ্ভাবন ও বাস্তবসম্মত তহবিল পরিকল্পনা করার।
প্যানেল সদস্যরা অবদানভিত্তিক সামাজিক বিমা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যত্ন অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে জাতিসংঘ নারী সংস্থার প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ বলেন, যত্ন ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে নারীদের অবৈতনিক যত্নের বোঝা কমে এবং তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
কেয়ার বাংলাদেশের উপ-দেশ পরিচালক এমেবেট মেনা বলেন, অর্থায়নব্যবস্থা টেকসই হওয়ার পাশাপাশি যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও জলবায়ুপ্রভাবিত এলাকাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) উপ-প্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি যত্ন শুধু প্রবীণদের বিষয় নয়, এটি সারা জীবনের যত্নব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়। যাতে জীবনের প্রতিটি ধাপে সেবা সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং মর্যাদাপূর্ণ হয়।
এডিবি সমর্থিত এই গবেষণা জাতীয় প্রবীণ নীতি ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির সঙ্গে সমন্বিত একটি জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি যত্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার গঠন যখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তখন সঠিক বিনিয়োগ, সমন্বয় ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি যত্নব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যা প্রবীণদের সুরক্ষা দেবে, নারীদের ক্ষমতায়ন করবে এবং ভবিষ্যৎ সমাজকে প্রস্তুত করবে।
এমওএস/একিউএফ

3 hours ago
9









English (US) ·