বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ জনপদ শুধু রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক কারণেই নয়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় দিক থেকেও অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। মেহেরপুর শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরের কুতুবপুর গ্রামে অবস্থিত স্বামী নিগমানন্দের আশ্রম সেই আধ্যাত্মিক আবহের উজ্জ্বল প্রতীক। ধর্মীয় সাধনা, ভক্তি, শান্তি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ আশ্রম শুধু ভক্তদের জন্য নয় বরং ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও আকর্ষণীয় গন্তব্য।
স্বামী নিগমানন্দ পরমহংসের জন্ম ১৮৮০ সালের ১৮ আগস্ট। ১৯৩৫ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি মারা যান। তিনি উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তন্ত্র, জ্ঞান, বেদান্ত, যোগ, ভক্তি ও প্রেম দর্শনের সমন্বয়ে শ্রীচৈতন্য ও শংকরের দর্শনের ভিত্তিতে নতুন আধ্যাত্মিক ধারা প্রচার করেছিলেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়; ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা—বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে তাঁর ভক্ত-অনুরাগী।
মেহেরপুরের কুতুবপুর আশ্রম তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত স্থান। যা ভক্তদের কাছে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। মেহেরপুর শহর থেকে কুতুবপুর আশ্রমের দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। যাতায়াত ব্যবস্থা তুলনামূলক সহজ ও সাশ্রয়ী। স্থানীয় অটোরিকশা, ভ্যান কিংবা মোটরসাইকেলে পৌঁছানো যায়। যাত্রাপথে দু’ধারের সবুজ শস্যক্ষেত, গ্রামের সরল মানুষ আর প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ভ্রমণকারীর মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়। শহরের কোলাহল থেকে সরে এসে অল্প সময়ের মধ্যেই যে শান্ত আবহ অনুভব করা যায়, তা ভ্রমণকারীর মনকে একেবারে ছুঁয়ে যায়।
আশ্রমে প্রবেশ করতেই দর্শনার্থীর চোখে পড়ে সাদামাটা অথচ শান্ত পরিবেশ। এখানে রয়েছে মন্দির, সাধনা কক্ষ এবং ভক্তদের জন্য নিরিবিলি প্রার্থনাস্থল। ভোর কিংবা বিকেলে আশ্রম প্রাঙ্গণে দাঁড়ালে পাখির ডাক, গাছপালার মৃদু দোল আর শীতল বাতাসের পরশ মনে এনে দেয় অদ্ভুত প্রশান্তি। চারপাশে নেই অতি আধুনিকতার কোলাহল বরং আছে সরলতা ও প্রকৃতির স্নিগ্ধ উপস্থিতি। দর্শনার্থীরা বলেন, ‘এখানে এলেই মনে হয়, মন থেকে সব দুঃখ-ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে।’
অনেকেই আশ্রমকে আখ্যায়িত করেন ‘শান্তির ঠিকানা’ হিসেবে। ভক্তদের বিশ্বাস, স্বামী নিগমানন্দ আশ্রমেই বহু বছর আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। প্রতি বছর আশ্রমে বিশেষ পূজা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে আশ্রম প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে দেশি-বিদেশি ভক্ত ও দর্শনার্থীতে। ভক্তিমূলক গান, প্রার্থনা, আচার-অনুষ্ঠানের আবেশে তখন গোটা পরিবেশ আধ্যাত্মিকতায় ভরে ওঠে।
শুধু ভক্তরাই নন, সাধারণ দর্শনার্থীরাও এ সময়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন স্বাদ পান। যদিও আশ্রমটি ভ্রমণকারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এখানে পর্যটন সুবিধা একেবারেই সীমিত। আশ্রম এলাকায় নেই কোনো বিশ্রামাগার বা খাবারের দোকান। তাই দর্শনার্থীদের শহর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। আবার ধর্মীয় পরিবেশ হওয়ায় এখানে ভ্রমণের সময় শালীন পোশাক পরিধান ও ভক্তদের অনুভূতির প্রতি সম্মান রাখা জরুরি।
কুতুবপুর গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে আশ্রম শুধু একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয় বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনেরও জায়গা। স্থানীয়দের মতে, আশ্রমের উপস্থিতি গ্রামে শান্তি, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়িয়েছে। অনেক দর্শনার্থী এখানে আসার ফলে স্থানীয়রা সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছেন। তবে তাদের প্রত্যাশা, সরকার বা বেসরকারি পর্যায়ে পর্যটন সুবিধা বাড়ানো হলে আশ্রম ঘিরে স্থানীয় অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
আশ্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে নিগমানন্দ ট্রাস্ট। ট্রাস্টের সেক্রেটারি ভারতের আসাম রাজ্যের স্বামী অবিনাশানন্দ স্বরস্বতী বলেন, ‘ধর্মের লক্ষ্য এক, মানুষের প্রেম এক, ঈশ্বর এক, আল্লাহ এক। পার্থক্য শুধু চাওয়া ও পাওয়ার পথে। আমরা সবাই একই পথের যাত্রী।’
যারা আশ্রমে ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য কিছু পরামর্শ হলো—ভোর বা বিকেলবেলায় গেলে আশ্রমের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়। শহর থেকে পানি ও হালকা খাবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো। ধর্মীয় স্থান হওয়ায় শালীন পোশাক পরিধান করুন এবং নীরবতা বজায় রাখুন। স্থানীয় গ্রামীণ পরিবেশকে সম্মান জানিয়ে আচরণ করুন।
কুতুবপুরের স্বামী নিগমানন্দের আশ্রম জেলার পর্যটন মানচিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সঠিক উদ্যোগ নিলে এটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয়দের মতে, আশ্রম এলাকায় যদি ছোট্ট বিশ্রামাগার, তথ্যকেন্দ্র ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা হয়। তবে দেশি-বিদেশি আরও বেশি পর্যটক আকৃষ্ট হবেন। স্বামী নিগমানন্দের আশ্রম হতে পারে অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এটি নিঃসন্দেহে মেহেরপুরের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এসইউ/এএসএম